আলোচনায় ‘মোমের পুতুল’: দর্শকের ইতিবাচক মন্তব্যে তৃপ্ত শামীম

সমাজের অধিকাংশ মানুষ তৃতীয় লিঙ্গদের বাঁকা চোখে দেখে। শুধু সমাজ নয়, নিজের পরিবার থেকে বন্ধুমহল স্বজনদের কাছ থেকেও পদে পদে তারা অবহেলার শিকার হন। একটা সময় এসব অপমান সইতে না পেরে ওই মানুষটি অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘড়ছাড়া হন। দু’মুঠো ডাল-ভাতের তাগিদে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন।

তেমনই একজন তৃতীয় লিঙ্গ মানুষের গল্পে নির্মিত হয়েছে ‘মোমের পুতুল’ নাটক। যেখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন শামীম হাসান সরকার। রোমান্টিক কমেডি নাটকের ভিড়ে সদ্য প্রকাশিত নাটকটিতে তার অভিনয় এতই জীবন্ত ছিল যে, শেষটা দেখে চোখে পানি এসেছে দর্শকদের। শামীমকে নিয়ে এ নাটকটি পরিচালনা করেছেন মুহাম্মদ মিফতাহ আনান। অন্যান্য চরিত্রে আরও অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, সাবেরী আলম প্রমুখ।

সত্যিকার অর্থে ‘মোমের পুতুল’ নাটক নয়, বরং চারপাশাপের বাস্তবতাই পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়ছে। তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ায় পরিবারে সন্তান নয়নের (শামীম হাসান সরকার) কদর নেই। উল্টো নানা বঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাকে। বাধ্য হয়েই তৃতীয় লিঙ্গদের দলে যোগ দিয়ে নানাভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু সন্তান ঘর ছাড়া হওয়ায় মা সাবেরী আলমের মনে মাতৃত্ব নানাভাবে তাড়িত করে। বাবা শহীদুজ্জামান সেলিম যখন তার সন্তান নয়নের জন্য কাঁদেন তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়!

যেহেতু নাটক, গল্পে নাটকীয়তা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নাটকীয়তার মধ্যেও যে মানবিকতাকে নাড়া দেয়া যায় ‘মোমের পুতুল’-এ শামীমের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে নির্মাতা তার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যেটা আর পাঁচটা সাধারণ নাটকে দেখা যায় না।

দুদিন আগে প্রকাশিত শামীমের ‘মোমের পুতুল’ নাটকটিকে ঈদের অন্যতম ‘ভিন্নধর্মী’ কাজ বলে মন্তব্যে জানাচ্ছেন দর্শক। ইতোমধ্যে সাত লক্ষাধিক দর্শক নাটকটি দেখেছেন। মন্তব্য করেছেন দুই হাজারের অধিক।

তবে শামীম হাসান সরকার বললেন, পরিচালকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ভিউয়ের জন্য নয়, কাজটি করেছি সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে। এ নাটকে কোনো নায়িকা নেই। তাই একদিনেই মিলিয়ন ভিউস হবে না। এটাও বোঝা উচিত। অল্প সময়ে দেখে যারা ইতিবাচক মন্তব্য করছেন এতে তৃপ্ত হচ্ছি। এখন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পাচ্ছি। আমার আন্টিরা ফোন করে প্রশংসা করছেন। যেটা অন্য কাজের ক্ষেত্রে পাই না। আলহামদুলিল্লাহ, দারুণ অনুভূতি।

শামীম জানালেন, ‘মোমের পুতুল’ চটকদার নয়, পুরোপুরি ইমোশনাল গল্পের নাটক। দর্শক এমন সব মন্তব্য করছেন চোখ এড়াচ্ছে না শামীমের। তিনি মনে করছেন, এগুলো অ্যাওয়ার্ডের মতো সম্মানের। দর্শকের ইতিবাচক মন্তব্যে আমি সম্মানীত, সতিক্য বলছি।

কেউ লিখেছেন, ‘আমরা যাদের ঘৃণার চোখে দেখি তারাই অনেকসময় আসল হিরো।’ কেউ কেউ বলেছেন, ‘মায়ের কাছে সন্তান সবসময় সোনার টুকরো’। কেউ কেউ আবার কেঁদেছেন, শপথ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচারণ করবেন, তাদের সুবিধা নিশ্চিত করবেন।

এছাড়া বেশিরভাগ দর্শক মন্তব্যে শামীমকে অমায়িক অভিনেতা হিসেবে তার জীবন্ত অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। কমেন্টবক্স দেখে অভিনেতা শামীম হাসান সরকার নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। আর সমালোচকরা বলছেন, ‘মোমের পুতুল’ নাটকটি হতে পারে শামীমের অভিনয়ের অন্যতম ‘টার্নিং’। বোদ্ধাদের মতে, ইউটিউব চ্যানেল ‘ম্যাংগো স্কোয়াড’ শামীমকে প্রথম প্রথম দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ ও ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’ জনপ্রিয় সিরিয়াল দুটি শামীমকে আলোচিত ও জনপ্রিয় করেছে। তবে ‘অভিনেতা’ হিসেবে শামীম হাসান সরকার নিজেকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেলেন ‘মোমের পুতুল’ নাটক দিয়ে।

তৃতীয় লিঙ্গের কোনো ব্যক্তির চরিত্রে এবারই প্রথম অভিনয় করলেন শামীম হাসান সরকার। তিনি মনে করেন, এ ধরনের চরিত্রের জন্য বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। শামীম জানান, প্রস্তুতি তো দূরের কথা, সহশিল্পী কারা তাও তিনি জানতেন না। জানার বোঝার সেই সময়টুকু পাননি। শুটিংয়ের আগের দিন পরিচালক মিফতাহর সঙ্গে ঘণ্টা তিনেক আলাপ করে পরদিন শুটিংয়ে নেমেছেন।

ঈদের জন্য দশটির মতো নাটক করেছেন শামীম। এর মধ্যে তিনদিন সময় বের করে ‘মোমের পুতুল’ নাটকের শুটিং করেছেন সাভার, তেজগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে এবং ইমপালস হাসপাতালে। শামীম হাসান সরকার বলেন, রিস্ক নিয়েই কাজ করেছি যেহেতু করোনা ছিল। প্রচারের পর ইউটিউবের মন্তব্য ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচ হাজার টেক্সট নিজের ইনবক্সগুলোতে পেয়েছি।

শনিবার চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপে শামীম হাসান সরকার বলেন, প্রথমে পরিকল্পনা ছিল আমার সহশিল্পীরা হবেন প্রকৃত থার্ড জেন্ডার (হিজড়া)। কিন্তু তারা ক্যামেরা, ফ্রেমিং অভিনয় কিছুই বুঝবে না, কাজটা খারাপ হতে পারে এই চিন্তা করে তাদের নেয়া হয়নি। শুটিংয়ে যেন চরিত্রটি ধরতে পারি সেজন্য সবাই আমার সঙ্গে হিজড়া মনে করে আচারণ করেছেন। প্রথমে আমি অভিনয় দিতে পারছিলাম না। কিন্তু পরিচালক থেকে পুরো টিম সাপোর্ট দেয়ায় শেষ করতে পেরেছি।

তিনি বলেন, নাটক প্রচারের আগে আমার শাড়ি পরা ছবি ফেসবুকে দেয়ায় কুড়ি শতাংশ মানুষ প্রশংসা করলেও অন্যরা এমন মন্তব্য করেছেন তখনই বুঝেছি শিক্ষার অভাব থাকায় সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কীভাবে দেখা হয়! মন্তব্য করার আগে ভাবা উচিত ছিল, সৃষ্টিকর্তা তাদের নিজেদেরকেও এভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন! শাড়ি, চুড়ি, লিপস্টিক, কানে দুল রেখে ৫৪ ঘণ্টা ধরে এ নাটকে অভিনয় করেছি। তখন আমি অনুভব করছি, সত্যি আমি যদি এমন হতাম কী করতাম? শুধু আমি নই, আমার সহশিল্পী প্রত্যেকেই তিনদিন ৫৪ ঘণ্টা এই বেশ ধরে অভিনয় করেছেন।

শামীম জানান, তার ১০টির মতো নাটক এবার ঈদে টিভিতে প্রচার হয়েছে। কিন্তু ইউটিউবে প্রকাশ পেয়েছে দুটি।

তিনি বলেন, ইউটিউবে না আসায় অনেকেই মনে করছেন ঈদে আমার কাজ নেই। মোটেও তেমনটা নয়। আমি খোঁজ নেয়ায় চেষ্টা করেছি কেন নাটকগুলো ইউটিউবে আসছে না। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। অনেকেই হয়তো বেশি ভিউসের আশায় পরে প্রকাশ করতে চাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ, দেরীতে হলেও একটা সময় কাজগুলো ইউটিউবে আসবে। সেগুলোও ভালো কাজ।

Full Video


ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এটা দেখেছেন কি? দেখে নিন